‘কীর্তিনাশা’ / সুবর্ণা গোস্বামী
আলোচক – ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
নবীন প্রজন্মের কবি সুবর্ণা গোস্বামীর কাব্যসংকলন ‘কীর্তিনাশা’ প্রকাশ করেছে
‘ধানসিড়িটির তীরে’ প্রকাশন । ৫৫টি কবিতা নিয়ে এটিই সুবর্ণার প্রথম কাব্যসংকলন ।
সংকলিত কবিতাগুলি কেমন ? আমি বলবো
কবিতাগুলি নিশ্চিত ভাবেই সৎ, পরিচ্ছন্ন ও হৃদয়বোধ সম্পন্ন এবং বেশ
পরিশীলিত কবি-মনের পরিচয় বাহী । আমার প্রাথমিক পাঠ প্রতিক্রিয়া এমনই ।
সংকলিত কবিতাগুলির রচনাকাল ২০১১ পরবর্তী
সময়ে । মীরপুর, ঢাকা নিবাসী পেশায় শিক্ষিকা, এখনও ত্রিশ না ছোঁয়া সুবর্নার কবিতা
লেখার শুরুও ২০১১তেই । প্রেম, প্রকৃতি , আমাদের যাপন চিত্র, জীবনের অন্বেষণ ও
জিজ্ঞাসা, দ্রোহ – সবই আছে কবিতাগুলিতে । কবিতা তাঁর কাছে কি ? তাও জানিয়েছেন
সুবর্ণা “ কবিতার চরণে যার হৃদয়, বাঁচেনা সে /তবুও বাঁচার যদি সাধ, প্রতিস্থাপন
করতে হবে/দ্বিতীয় হৃদয়, ক্ষুধার দুর্বিপাক অসুখেরও নির্বাসন” (‘কবিতার গ্রাস’) । কবিতাকে
ভালোবাসেন সুবর্ণা, কবিতা তাঁর কলমে ধরা দেয় স্বতস্ফূর্ততায় । সুবর্ণা লেখেন “
কবিতার সোজা সাপটা ঝড় হানা দেয় অন্দর মহলে” (‘কবিতার ধাঁধাঁ’) । তবুও নিজেকে কবি
বলতে কুন্ঠা বোধ করেন তিনি । বলেন “আমি সবিনয়ে বলি আমাকে কবি বলে ডাকবেন না” ।
না, এই পংক্তিটিকে আমি কবির নিছক
স্বীকারোক্তি রূপে দেখছি না । বরং এই উক্তির পিছনে খুঁজতে চেয়েছি কবির না বলা
যন্ত্রনার ইঙ্গিত । মনে হয়েছে, কবিতার বিষয় ভাবনায় পীড়িত মানুষের বেদনার কেন্দ্রে
হাত না রাখতে পারার যন্ত্রণা হয়তো বা কবিকে বিদ্ধ করে । এই কবিতাটিতেই কবির সাহসী
উচ্চারণ –
“আমি বসন্তের ফুলকে ঠেলে দেব আহত বাঘের খাঁচায়
রঙধনুকে মুড়িয়ে দেব কাফন-চাদরী সাদায়
গোধুলির ঘোমটা খুলে নগ্ন স্বাধীনতা দেখাব মাঝ দুপুরে
রক্তজবাকে শেষ বারের মত উষ্ণ রক্তে ধুয়ে – ঘুচিয়ে দেব
দেবই – নিরীহের রক্তে করা শাসকের স্নান” ( ‘সনির্বন্ধ অনুরোধ’)
।
কবিতাগুলির নির্বাচনে বেশ যত্নের ছাপ রয়েছে
। বিষয় ভাবনায় ভিন্নতা আছে, কিন্তু কোন অপটু কবিতা যায়গা পায়নি । আটপৌরে দেশজ
শব্দের ব্যবহারে কবিতাগুলি পড়তে ভালো লাগে । সংকলিত কবিতাগুলির বিষয় ভাবনায় আপাত
ভিন্নতার মধ্যেও একটা ঐক্যের সুর প্রচ্ছন্ন – তা হ’ল এক মহত্তর জীবনের বোধ,
অন্বেষণ ও জিজ্ঞাসা । মহত্তর জীবনের অন্বেষণেই কবি উচ্চারণ করেন
–
“আমি জীবন্ত মানুষের জন্য খুঁজি
পোড়া রুটি চাঁদ,
শীতবস্ত্র, ছাদ
অস্ত্র হাতে মানুষের কঙ্কাল খুঁজি না” (‘অহংকারী’) ।
এই উচ্চারণের মধ্যে নিশ্চিত ভাবেই কবির
কাব্যদর্শনের ইঙ্গিতও পাওয়া যায় । ‘কীর্তিনাশা’র কবিতাগুলি পড়ে আমার মনে হয়েছে
কবিতাগুলির মধ্যে নিজেকেই খুজতে চেয়েছেন । কবিতার তন্ময় প্রেমিক কবি সুবর্ণা লেখেন
“নির্বাক করে আমায় তোমার ধ্বনির উদ্দামতায় ! আকুল প্রসব কর কবিতা ... / নীলাদ্রী
যেমন অনিবার জন্ম দেয় ঢেউ এর পর ঢেউ” ( ‘নীল চন্দনের জন্য’) । চেয়েছেন ‘শব্দের
বোধনে প্রাণ প্রতিষ্ঠা’ ।
সংকলিত সব কটি কবিতাই লিখেছেন আমাদের নিত্যদিনের
পরিচিত সহজ শব্দে, আর এই আটপৌরে দেশজ শব্দেও লাবণ্যের দ্যুতি ছড়িয়েছেন সুবর্ণা ।
পাঠক তো কবিতার কাছে আসেন মাধুর্যের আকর্ষণেই ।
‘কীর্তিনাশা’র প্রচ্ছদ একেছেন অমিতাভ দাশ ।
বেশ উজ্জ্বল ও শোভন ও আকর্ষণীয় প্রচ্ছদ । বইটির মুদ্রনেও যত্নের ছাপ স্পষ্ট । ৬৪পৃষ্ঠার
বইটির দাম ভারতে ১০০টাকা, ঢাকায়
১৫০টাকা । নবীন কবি সুবর্ণা গোস্বামীর বইটি দুই বাংলাতেই সমাদৃত হবে বলেই
আমার বিশ্বাস ।