তাঁর লেখা পড়ে বড় হয়নি এমন বাঙালি খুঁজে
পাওয়া যাবেনা । জীবনকাল মাত্র মাত্র ৩৫ বছর ১০মাস ১০দিন,
দেখে যেতে
পারেননি নিজের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থটিও । তিনি বাংলা শিশু-সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ সুকুমার
রায় । উনিশ শতকের বাংলায় বুদ্ধির
জাগরণকালের এক আশ্চর্য ব্রাহ্ম পরিবারে জন্ম সুকুমারের,
যেখান
থেকে পেয়েছিলেন জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলা চর্চার অনন্য উত্তরাধিকার । পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী,
বাংলা
শিশুসাহিত্যের পিতৃপুরুষ । জেঠামশাই সারদারঞ্জন ছিলেন সে যুগের বাংলায় প্রথম ক্রীড়া
সংগঠক , বাংলায় ক্রিকেট খেলার জনক ।
পারিবারিক উত্তরাধিকারে সমৃদ্ধ সুকুমার যেমন
তাঁর স্বল্পায়ু জীবনেই শিশসাহিত্যের প্রবাদপুরুষ হয়ে আছেন,
তেমনই
দিদি সুখলতা, ছোট বোন পূণ্যলতা,শান্তিলতা,
ভাই
সুবিনয় এবং খুড়তুতো বোন লীলা (মজুমদার)
শিশুসাহিত্যেই কৃতবিদ্য ।
১৮৮৭ অক্টোবর ৩০, কলকাতা - জন্ম
১৮৯৬ ... প্রথম কবিতা ‘নদী’ প্রকাশ ‘মুকুল’ পত্রিকা জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়
১৯০২ ... সিটি কলেজিয়েট স্কুল থেকে
প্রবেশিকা পাশ ও প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি
১৯০৫ ... বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষ্যে নাটক ‘রামধন বধ’ রচনা ও অভিনয়
১৯০৬ ... পদার্থ ও রসায়ন বিদ্যায় অনার্স সহ
স্নাতক। প্রথম গদ্যরচনা ‘সূর্যের
রাজা’প্রকাশ, ‘ননসেন্স ক্লাব’এর সূচনা ।
১৯১০ ... প্রবাসী পত্রিকার লেখেন প্রবন্ধ ‘ভারতীয় চিত্র শিল্প’ , নাটক ‘লক্ষণের শক্তিশেল’ ‘ঝালাপালা’ রচনা ।
১৮১১, অক্টোবর ... ‘প্রবাসী’তে ‘ফোটোগ্রাফি’ প্রবন্ধ প্রকাশ । গুরুপ্রসন্ন
স্কলারশিপ নিয়ে বিলাত যাত্রা ।
১৯১৩ ... সেপ্টেম্বরে মুদ্রন পযুক্তির উচ্চতর
শিক্ষান্তে ভারতের প্রথম এফ আর পি এস হয়ে দেশে ফিরে আসা, ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় যোগদান । এই বছর ১৩ই
ডিসেম্বর সুপ্রভা দাসের সঙ্গে বিবাহ ।
১৯১৫ ... পিতা উপেন্দ্র কিশোরের মৃত্যু, ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব
গ্রহণ ।
১৯২১ ... ২রা মে একমাত্র পুত্র সত্যজিতের
জন্ম । এই মাসের শেষের দিকে, তখনকার দিনে দূরারোগ্য
কালাজ্বরের সংক্রমণ হয় ,স্বাস্থোদ্ধারের জন্য দার্জিলিং গমন ।
১৯২৩ ... ২৯শে আগষ্ট রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ
সুকুমারকে দেখতে এলেন, মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন এবং নয়টি গান শোনালেন ।
১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮-১৫ মিনিটে ৩৫ বছর ১০
মাস ১০দিন বয়সে মৃত্যু ;
প্রথম গ্রন্থ ‘আবোল তাবোল’এর প্রকাশ দেখে যেতে পারেন নি ।
মৃত্যু শয্যায় শায়িত হয়ে বইটির প্রুফ দেখে দিয়েছিলেন । মৃত্যুর ৯দিন পরে তাঁর
প্রথম পুস্তক ‘আবোল তাবোল’ প্রকাশিত হয় । ‘আবোল তাবোল’এর শেষ কবিতাই সুকুমারের শেষ
রচনা লিখেছিলেন রোগ শয্যায়, মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পিতার
মৃত্যুর পর সুকুমার ‘সন্দেশ’এর সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন
। এই নয় বছরে (শেষ আড়াই বছরের
শয্যাশায়ী অবস্থা সহ) সুকুমার লিখেছিলেন
১০৩টি কবিতা, ৮৮টি নানা ধরণের ছোট গল্প, ১২২টি প্রবন্ধ, ৩৭টি জীব-জন্তু
বিষয়ক লেখা, ১৬টি জীবনীমূলক কাহিনী ৮টি নাটক
ও ২টি বড় গল্প আর এঁকে ছিলেন পত্রিকার সমস্ত
ছবি ।
এছাড়া, বড়দের জন্য একমাত্র গ্রন্থ ‘বর্ণমালা তত্ব’,
‘প্রবাসী’
তে
প্রকাশিত ফোটোগ্রাফি বিষয়ক প্রবন্ধ, লন্ডনের ‘জার্নাল অফ ফোটগ্রাফি’তে ছাপা একটি প্রবন্ধ,
‘কোয়েস্ট’
পত্রিকায় ‘দি স্পিরিট অফ রবীন্দ্রনাথ’
প্রবন্ধ ও
দুটি ধর্ম সংগীত ।
শিশুমনকে যেমন বুঝেছিলেন সুকুমার –
“সাগর যেথা লুটিয়ে পড়ে নতুন
মেঘের দেশে
আকাশ-ধোয়া নীল যেখানে সাগর জলে মেশে।
মেঘের শিশু ঘুমায় সেথা আকাশ-দোলায়
শুয়ে-
ভোরের রবি জাগায় তারে সোনার কাঠি ছুঁয়ে।”
শিশুমনকে স্পর্শ করা, তাদের এমন
আপনজন আর কি কাউকে পাবো ?
লীলা মজুমদার আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন যে
সুকুমার রায় ভুল সময়ে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন । তাঁর মনে হয়েছিল ‘ঐ সময়ে সুকুমারের জন্য দেশটা
প্রস্তুত ছিলনা’ ।
ছোটদের জন্য যে সাহিত্য রচনা বিগত দেড়শ’
বছর ধরে
হয়ে আসছে তাকে আমাদের সাহিত্য আলোচকরা কেন সাহিত্যের মর্যাদা দিতে কুন্ঠা বোধ করেন
সে এক রহস্য । কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের পাঠ্য বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে শিশু
সাহিত্যের কোন উল্লেখ নেই । সেই পাঠ্য ইতিহাস তন্ন তন্ন করে খুজলেও সার্থক শিশু-সাহিত্যিকদের
সম্পর্কে একটা অক্ষরও খুজে পাওয়া যাবেনা ।
আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক বিন্যাশ বদলে
গেছে – নিয়ত বদলে যাচ্ছে এবং সেই বদলের প্রক্রিয়াতেই চুরি হয়ে গেছে আমাদের সন্তানদের
শৈশব । এখন আর ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ’ ওঠেনা ,
‘শোলক বলা
কাজলা দিদি’রাও আর নেই । সে আর ঘুমাতে যায়না ‘ঘুম পাড়ানি মাসি-পিসির’ গল্প শুনে । শৈশব নেই ,
সুতরাং শিশুসাহিত্যও
নেই ।
তবুও সুকুমার রায় আছেন,
থাকবেন
তাঁর রচনার মধ্যে, থাকবেন শিশু মনে ।
চিরন্তন হয়ে থাকবে এই ডাক –
আয়রে ভোলা খেয়াল-খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
কী চোখে জীবনকে দেখতেন সুকুমার ? তাঁর
খেয়ালরসের কাব্যের উৎস ছিল তাঁর গভীর
জীবনবোধ । একজন শিল্পী কোন জাদুতে জীবনের
সঙ্গে নিজের শিল্পবোধকে একাত্ম করে দিতে পারেন তার পরিচয় পাওয়া যায় সুকুমারের
অন্তিম রচনা ‘আবোলতাবোল’এর শেষ
কবিতায় । আসন্ন মৃত্যুর পদধ্বনি শুনতে
পেয়েও লিখেছিলেন পরমাশ্চর্য জীবনরস সিক্ত প্রত্যয়ের কবিতা ‘আবোলতাবোল’ –
‘আজকে দাদা
যাবার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে –
নাইবা তাহার অর্থ হোক
নাইবা বুঝুক বেবাক লোক ।
আপনাকে আজ আপন হাতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে ।
ছুটলে কথা থামায় কে ?
আজকে ঠেকায় আমায় কে ?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ তলা বাজে –
রাম-খটাখট ঘ্যাঁচ
কথায় কাটে কথার প্যাঁচ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার ।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত
মঞ্চে নাচেন পঞ্চভূত !
হ্যাংলা হাতি চ্যাং-দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা ।
মক্ষিরাণী পক্ষিরাজ –
দস্যি ছেলে লক্ষি আজ
আদিমকালের চাঁদির হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম ।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর’ ।
মৃত্যুর প্রায় একশ’ বছর পরেও সুকুমার রায় আপন
প্রতিভা ও বৈশিষ্ট্যে পাঠকে হৃদয়ে
উজ্বলতর হয়ে আছেন । শুধুমাত্র শিশুতোষ পদ্যের লেখক হলে তা সম্ভব হত না কিছুতেই ।
শিশু তাঁর কবিতার উপলক্ষ্য, বস্তুত সুকুমার রায় সাবালক সাহিত্যের স্রষ্টা ।