বাহারে,কি ছড়াকার!
যোগীন সরকারের নাম প্রথম শুনি আমার দিদিমার কাছে। নামটি অবশ্যই যোগীন সরকার নয়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার কিন্তু ওই নামেই তিনি অধিক পরিচিত।
আমার
দিদিমা বেঁচে থাকলে আজকের দিনে তাঁর বয়স হত প্রায় একশ আট বছর। সেকালের মহিলা,
প্রথাগত বিদ্যাশিক্ষা ছিলনা, কিন্তু গৃহশিক্ষার ফলে লেখাপড়া জানতেন। বাড়ির দলিল দস্তাবেজে নিজে নাম সই করতেন, চিঠি-চাপাটি লিখতেও দেখেছি। আর
ছিল অদ্ভুত এক ক্ষমতা, মুখে মুখে ছড়া তৈরি করতে পারতেন। ঘুরছেন, ফিরছেন, কাজকর্ম করছেন কিন্তু বিশেষ কেউ এলে
বা বিশেষ কিছু নজরে পড়লে তৎক্ষণাৎ সেই বিষয়ে ছড়া তৈরি করে ফেলতেন। যেমন, সারাদিনের
পর বাড়ি ফিরেছি, হয়ত সেদিন ঠিকমত খেয়ে যাইনি, অমনি বলে উঠলেন---
মজবুত শরীর হলে
তবে মাথায় বুদ্ধি গজায়
জানো না কি
রাজত্ব করে রাজায়...
কিংবা বাড়িতে ভিখারি এসে পয়সা চাইছে, সে
টাকা নেবে, পয়সায় মন উঠছে না। দিদিমা অমনি বলে উঠলেন—
পয়সা নয়, টাকা
যতই দাও ফাঁকা।
এ
হেন দিদিমার কাছে শিশুকালে যে যোগীন সরকারের নাম শুনব তাতে আর আশ্চর্য্য কি!
দিদিমায়ের দৌলতেই বুঝি আমিও ছড়া-প্রেমিক।
ছড়া
নিয়ে এত কথা বলার একটাই কারণ, এই বৎসরটি ছড়াকার যোগীন সরকারের জন্মের সার্ধ
শতবৎসর।যোগীন্দ্রনাথ সরকারের জন্ম ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে কিন্তু জন্ম তারিখটি জানা যায় বাংলায়, ১২ই কার্তিক। যোগীন সরকারের আদি নিবাস যশোর জেলায়। ২৪ পরগনা জেলার নেত্রা বা
নেত্রা নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বিখ্যাত নীলরতন সরকার মশাই ছিলেন যোগীন সরকারের দাদা। এন্ট্রান্স
পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতায় এসে সিটি কলেজে ভর্তি হলেও প্রথাগত শিক্ষা সমাপ্ত
করেননি, যদিও সিটি স্কুলেই তাঁর প্রথম চাকরি জীবন শুরু করেন শিক্ষকতা দিয়ে।
যোগীন
সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হল শিশুদের ছবি এঁকে অক্ষর চেনানোর চেষ্টা । ছোটদের
জন্য লিখতেন। তাঁর ‘হাসিরাশি’, ‘হাসিখুশি’ আর ‘খুকুমনির ছড়া’ হল বিখ্যাত ছোটদের
বই, যে বই আমাদের বাবা-মায়েরাও পড়েছেন এমন কি তাঁদের বাবা-মায়েরাও। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই ছিল ‘হাসিখুশি’, ১৮৯৭ সালে
প্রকাশিত হয়। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত ‘খুকুমনির ছড়া’।
১৮৯৬
সালেই নিজস্ব একটি প্রকাশনা ছিল, যার নাম ছিল সিটি বুক সোসাইটী। এই প্রকাশনা থেকে
প্রথম প্রকাশিত বই হল, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোটদের রামায়ণ। যোগীন্দ্রনাথ
সরকারের সাহিত্যজীবন ছিল শিশুদের জন্য উৎসর্গীকৃত।
ছোটদের
জন্য নানা মজার ছড়া, হাসির ছড়া লিখতেন। আর লিখতেন আজগুবী সব ছড়া যা আমরা পরবর্তী কালে পাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর
পুত্র সুকুমার রায়ের রচনায়। বস্তুতঃ, তাঁর রচনার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্যের শিশু
সাহিত্যটি এগিয়ে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের কথায় যোগীন্দ্রনাথ সরকার হলেন শিশু
সাহিত্যের ভগীরথ। একটী
উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে তাঁর রচনার ধরণ.....
মজার দেশ
এক যে আছে মজার দেশ, সব রকমে ভালো,
রাত্তিরেতে বেজায় রোদ দিনে চাঁদের আলো!
আকাশ সেথা সবুজবরণ গাছের পাতা নীল
ডাঙ্গায় চরে রুই কাতলা জলের মাঝে চিল।
সেই দেশেতে বেড়াল পালায়,নেংটি ইঁদুর দেখে,
ছেলেরা খায় ক্যাস্টর-অয়েল,রসগোল্লা মেখে!
মন্ডা মেঠাই তেতো সেথা ওষুধ লাগে ভালো
......
(ছড়াটির
সবটুকু দিলাম না, কারণ যোগীন্দ্রনাথের আরো দুটি কবিতার সঙ্গে এটিও এই পত্রিকাতেই অন্যত্র দেওয়া হয়েছে ।) পরবর্তী কালে এই ভাবনা থেকেই আমরা পাই সুকুমার রায়ের আবোল-তাবোল, হযবরল এবং সেই বিখ্যাত
পংক্তি— ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল’ এবং যা পাওয়া যায় চক্ষু মুদলে, খোলা চোখে নয়!
যোগীনের
ছড়ার মধ্যে আছে সূক্ষ বিদ্রূপও। ‘ ছেলেরা সব খেলা ফেলে বই নে বসে পড়ে’- ছড়ার এই
পংক্তিটি পড়লে তার অর্থ ধরা যায়। বস্তুতঃ, শিশুদের জগত খেলার জগত। তা না করে অতি শিশুকাল থেকেই তার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা, যার ফলে শিশু তার নিজস্ব
জগতকে
হারিয়ে ফেলছে যেমন, বড়দের জগতে পা রাখতেও অক্ষম এই শিশু বয়সে। পিতা-মাতার চিন্তার
কথা বৈকি!
বয়সকালে
এই ছড়া ও ছবির মানুষটি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন, কিন্তু সেই অবস্থাতেও তিনি রচনা করে গেছেন শিশুদের জন্য। ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে
বাংলার ১২ই আষাঢ তাঁ জীবনাবসান ঘটে।
তাঁর জন্মের সার্ধশত বর্ষে তাঁকে আমাদের
সশ্রদ্ধ প্রণাম।
খুকু-খোকার ছড়া
ঝর্ণা চট্টোপাধ্যায়
খুকুমনি পড়ে যা
খোকাবাবু পড়ে তায়
যোগীনের ছড়াগুলি
মুখে মুখে বলে যায়
‘হাসিরাশি’ ‘হাসিখুশি’
নয় শুধু ছোটরা
আমরাও পড়েছি তা
পড়ে বাবা-মায়েরা।
ছবি দেখে অ-আ ক-খ
আগে কি কেউ শিখত
যোগীন তাই অক্ষর
ছবি এঁকে চেনাত(চেনাতেন)।
যোগীনের ছড়াগুলো
পড়লেই মজা পাবে
কখনো হাসতে হবে
কখনো ভিরমি খাবে।
দোকানে জিনিস কিনো
লিস্টিটা মিলিয়ে
ভোলা-ভুতোর দেখলে খেলা
সব যাবে গুলিয়ে।
হারাধনের দশটি ছেলের
পড়েছ তো ছড়াখানা
মেলায় হারিয়ে গেলে
জুড়ো না যেন কান্না!
ছড়ার দেশেতে আছে
শুধু হাসি শুধু মজা
খোকা-খুকু কেবল হাসে
পায় না তো কোন সাজা।
জানো কি ছড়ার দেশে
রাতে রোদ, দিনে চাঁদ
এখানে পাতে না কেউ
কথায় কথার ফাঁদ।
তাই তো বলি খোকাখুকু
থাকো হাসিখুশিতে
যোগীনের বই পড়ো
ছড়া ও ছবিতে...