একুশের অলৌকিক ভোরে
ফিরে দেখা ইতিহাস
একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির
বড় গৌরবের দিন। এই দিনটিতেই আমাদের মাতৃভাষা বাংলা ঘরের পাশের চিরচেনা শান্ত দিঘির
রূপটি ছেড়ে হয়ে উঠেছে এক অপার সমুদ্র। এক আন্তর্জাতিক তরঙ্গ।
যে কোন ভাষার আন্তর্জাতিক
হয়ে ওঠা এক বিস্ময়কর যাত্রা। বাংলা ভাষাজননীকে আন্তর্জাতিকতার এই মুকুট পরিয়েছেন একদল
ছাত্র। আজ থেকে পঁয়ষট্টি বছর আগে এই দিনটিতেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঊর্দুর পাশাপাশি বাংলার
সম-অধিকার চেয়ে ঢাকার রাজপথে নেমেছিলেন বাঙালি ছাত্ররা। দাম্ভিক শাসকদের জবাব এসেছিল
বুলেটে। রফিকউদ্দিন আহমেদ, আবদুস সালাম, আবুল বরকত, আবদুল জব্বারের রক্তে ভিজে গিয়েছিল
ঢাকার রাস্তা। কিন্তু বাংলা বিদ্বেষী শাসকদের শত অত্যাচার আর নিপীড়নেও থেমে যায়নি মাতৃভাষার
মর্যাদা রক্ষায় বাঙালির সেই সংগ্রাম। তখন রবীন্দ্রনাথ নেই, কিন্তু তাঁর বাণী অন্তরে
নিয়ে, তাঁর গান গাইতে গাইতেই বাংলা ভাষাজননীর মর্যাদা রক্ষায় শামিল হয়েছিলেন আপামর
বাঙালি।
শেষপর্যন্ত ১৯৫৪ সালে অন্যতম
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসকরা। ১৯৫৬
সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান সংবিধানের ২১৪(১) অধ্যায়টি সংশোধন করে রাষ্ট্রভাষা
সম্পর্কে লেখা হয়েছিল: “The state language of Pakistan shall be Urdu and
Bengali.”
এল ১৯৭১। পৃথিবীর মানচিত্রে
একমাত্র বাংলাভাষী রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান
বাঙালিদের শুধু স্বাধীন করেননি, বাঙালির মাতৃভাষাকেও পাঠিয়েছেন আন্তর্জাতিক জয়যাত্রায়।
বাংলার ভাষা আন্দোলনের উজ্জ্বল
অধ্যায়টির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এসেছিল ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর। সেদিন ইউনেস্কোর প্যারিস
অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা
হল। সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিনটি জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলিতে
যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হবে।
আমাদের গড়পড়তা যাপনে বাংলা
ভাষা
আমরা গড়পড়তা বাঙালি প্রতি
বছর একুশে ফেব্রুয়ারির সময় বাংলা ভাষা নিয়ে আবেগ আর উচ্ছ্বাসের বাঁধভাঙা প্রাবল্যে
ভেসে যাই। কুম্ভকর্ণের ঘুম ভেঙে হঠাৎ চোখ মেলি একুশের সকালে। সেদিন পাটভাঙা পাঞ্জাবি-উত্তরীয়
কিংবা বাংলা হরফ-ছাপ তাঁতের শাড়ি আর বড় টিপে সেজে বাংলা আকাদেমির সামনে ফাগুনের হাওয়ায়
ভেসে আসা বাংলা গানের সুরে দুলতে দুলতে অপেক্ষা করি ভাষাদিবস উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারের।
আস্ফালন করে বলি, বাংলা পৃথিবীর পঞ্চম ভাষা, কলকাতাই ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী। আর
অনিবার্যভাবে গর্ব করি বাংলা ভাষাজননীর শ্রেষ্ঠ সন্তান রবি ঠাকুরের বাংলা ভাষায় নোবেল
প্রাপ্তি নিয়ে।
আর তার পরে? স্রেফ ভুলে যাই।
বছরের বাকি ৩৬৪ দিন বাংলা ভাষা নিয়ে আমাদের আর কোন ভাবনা নেই। সে ভাষা রইল না গেল,
তা নিয়ে আমাদের মনে আর কোন আলোড়ন নেই।
অথচ ভাষা একটা সংস্কৃতির
ধারক আর বাহক। এই ভাষার জন্যে প্রাণ দিয়েছেন শহিদরা। এই ভাষার সম্মান আর স্বীকৃতির
সংগ্রাম ক্রমশ একটা দেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠেছে। তাহলে এই ভাষার
সঙ্গে একাত্ম আবেগকে কী করে ভুলে যেতে পারি আমরা? বাংলা ভাষা নিয়ে উত্সব খুব আনন্দের।
কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারির উচ্ছ্বাসের আতিশয্যে সেই উত্সবের সমাপ্তি নয়। উত্সবের মূলে
যে আবেগ আর ভালবাসা, প্রতিদিনের জীবনে তাকে সঙ্গী করতে হবে।
বিশ্বায়ন ও বাংলা ভাষা .
আজকের এই বিশ্বায়নের দুনিয়ায়
আন্তর্জাতিক বাঙালির কাছে বাংলা ভাষার ভূমিকাটা ঠিক কী? মর্যাদা আর গুরুত্বই বা কতটা?
‘গ্লোবাল’ বাঙালির জীবনধারণের অনিবার্যতায় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি বাঙালির চিরায়ত আকর্ষণ
আর ভালবাসা কি ক্রমশ পথ হারাচ্ছে? এইসব নানা প্রশ্ন ভিড় করে আসে মনে।
সন্তানের ভবিষ্যতের ভাবনা
থেকে আমরা, বাঙালি অভিভাবকেরা আজ পড়াশোনার মাধ্যমে হিসেবে মাতৃভাষার প্রতি ভরসা রাখতে
পারছি কি তেমন করে? আমরা আমাদের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পাঠাই। বিশ্বাস করি,
তবেই তারা এই বিশ্বায়নের দুনিয়ার উপযুক্ত ভবিষ্যত নাগরিক হিসেবে তৈরি হয়ে উঠবে, তবেই
তারা দুধে-ভাতে থাকবে। আর্থ-সামাজিক কারণে যারা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে সন্তানকে পাঠাতে
পারি না, তারা হীনমন্যতায় ভুগি। কারণ আমরা ভাবি, ইংরেজি ভাষাই সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ে
দেবে।
একসময় ভাবা হত শুধু ইংরেজিতে
কথা বলা আর শোনা নয়, ইংরেজিতে স্বপ্ন দেখতে হবে, তবেই ভাল করে ইংরেজি শেখা যাবে। আর,
ভাল ইংরেজি শিখতে গেলে বাড়িতে বাংলা বলা একদম চলবে না। এই পদ্ধতি এখন অচল। তবু দেখা
যায় ইংরেজি ভাষা শেখাতে গিয়ে অনেক বাবা-মা ছেলেমেয়েদের প্রায় বাংলা ভাষা ভুলিয়ে দেবার
ব্যবস্থা করেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাবিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকারের একটি লেখার অংশবিশেষ তুলে
না দিয়ে পারছি না:
“অনেক বাবা-মা নিজেরা শিক্ষক
শিক্ষিকাদের মতো যথেষ্ট ইংরেজি জানেন না, কিন্তু তাঁরা স্কুলের বাইরে তাঁদের ছেলেমেয়েদের
ইংরেজির দুর্ধর্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা হয়ে ওঠেন। স্কুলে যেতে বা স্কুল থেকে বাড়িতে ফিরে
আসার সময় ছেলেমেয়েদের বাঙালি ইংরেজি উচ্চারণে বলেন,
‘লুক টিটু, দি ম্যান ইজ রাইডিং
অন এ হর্স।’
'দি' কোথায় 'দ্য' গোছের হবে,
'এ' কোথায় 'আ' গোছের হবে, রাইডিং এর পর অন হবে কি না, এ সম্বন্ধে তাঁদের অনেকের কোনও
ধারণা নেই, কিন্তু ছেলেমেয়েকে তাঁদের ইংরেজি জ্ঞান দিয়ে সমৃদ্ধ করতে তাঁরা কোমর বেঁধে
লেগে যান। কাজেই ছেলেমেয়ে যদি বলে ওঠে,
‘মা ওই দ্যাখো, একটা বেড়াল
দৌড়ে রাস্তা পেরল।’
তখন তাঁরা বকে ওঠেন,
‘বেড়াল বললে কেন টিনা, ক্যাট
বলতে বলেছি না?’
এবং রাস্তা ঘাটে প্রাণপণ
তাঁরা ওয়ার্ডবুকের মত ছেলেমেয়েদের প্রতিশব্দ শেখাতে থাকেন,
‘গরু নয় কাউ। কুকুর নয় ডগ।
হাতি নয় এলিফ্যান্ট। ইঁদুর নয় মাউস।’
আসলে বাবা মা-দের এই মরিয়া
চেষ্টার কারণ তাঁদের মানসিক বিপন্নতা। তাঁরা মনে করেন ইংরেজি ভাষা শিক্ষাই সন্তানের
সাফল্যের চাবিকাঠি। কিন্তু ইংরেজি বা অন্য কোন ভাষা শেখার জন্য বাংলা ভোলার প্রয়োজন
হয় না।
শিশুবয়সেই গ্রহণ করার ক্ষমতা
সবচেয়ে বেশি। তাই সেসময়ে একাধিক ভাষা শেখা ছোটদের পক্ষে মোটেই কঠিন নয়। বরং যে বাচ্চারা
একাধিক ভাষা শেখে, দেখা যায় তাদের মেধা একটিমাত্র ভাষা জানা বাচ্চার থেকে অনেক বেশি।
ভবিষ্যতের সুযোগ সুবিধার কথা ভেবে আমাদের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিখুক, কিন্তু বাংলা ভাষার
ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সঙ্গেও তারা সমানভাবে পরিচিত হোক। ইংরেজি আর বাংলা গল্পের মধ্যে
দিয়ে দুটো ভাষার প্রতিই তাদের আগ্রহ তৈরি করা সম্ভব। এই দায়িত্বটুকু অভিভাবকদের নিতে
হবে। একবার বাংলা ভাষার প্রতি এই আগ্রহ সৃষ্টি হলে তারা নিজেরাই বই তুলে নেবে হাতে।
অন্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও ভালবাসতে শিখবে।
প্রবাসে বাংলা ভাষা ।
দেশের থেকে অনেক দূরে আছি
বলে বুঝতে পারি, বাংলা ভাষার প্রতি সন্তানদের এই ভালবাসা তৈরি করাটা দেশে থেকে যত সহজ,
তার চেয়ে অনেকগুণ কঠিন বিদেশে। তাই বিদেশে অনেক বাবা মা-ই সেই কঠিন পথটা এড়িয়ে চলেন।
বাংলা ভাষার সঙ্গে পরবর্তী প্রজন্মের সংযোগ ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এভাবেই আমাদের
ভাষার ঐশ্বর্য অধরা থেকে যায় আমাদের সন্তানদের কাছে, আর আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধীরে
ধীরে যায় হারিয়ে। যে ভাষার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, যে ভাষায় আমাদের ভালবাসার
প্রকাশ, বিদেশে থেকে যখন দেখি অনেক পরিবারে ঠিক পরের প্রজন্মের কাছেই সে ভাষা অর্থহীন
হয়ে পড়ছে, তখন আশঙ্কা হয়- তবে কি অন্য ভাষা আর সংস্কৃতির কাছে বাংলা ভাষা মাথা নত করবে?
আট সপ্তাহ বয়স থেকে আমাদের
ছেলের দিনে ন’ দশ ঘন্টা সময় কাটত ডে-কেয়ারে। সেখানে সারাদিন ইংরেজি কথা, ইংরেজি গল্প,
ইংরেজি গান শোনা। তাই বাড়িতে ইংরেজি নৈব নৈব চ, বাড়িতে শুধু বাংলা। দেড় বছর বয়স হতে
দেখা গেল, ইংরেজি আর বাংলা- দুটো ভাষার কথাই সে বোঝে, তবে বলছে মূলত ইংরেজি। বাংলা
গল্প শোনা, গান শোনা, ছড়া-কবিতা শোনা আর একসঙ্গে গান গাওয়ার মধ্যে দিয়ে বাংলা ভাষার
প্রতি আগ্রহ তৈরি হল। দেখা গেল, তিন-সাড়ে তিন বছর বয়সে সে একই কথা ইংরেজি আর বাংলা
দুটো ভাষাতেই বলতে পারছে। এখন ছ’ বছরে এসে দেখি, মুখের কথায় ইংরেজির মতোই বাংলা অবিরল।
চেষ্টা করছে নিজের মত করে ইংরেজি আর বাংলাতে টুকরো টুকরো গল্প তৈরি করার। তবে এভাবে
শুধু কথা শুনে বা গল্প শুনে বাংলা শেখা ও বলা যথেষ্ট নয়। খুব জরুরি হল, ছোটদের বাংলা
অক্ষর পরিচয় আর লিখতে শেখানো। এই সময় আমার এই মার্কিন শহরে বাংলা স্কুলের অভাব অনুভব
করি খুব।
সন্তানদের বাংলা ভাষা শেখাটা
সম্পূর্ণ করে তুলতে পারলে নিজের শিকড়ের সঙ্গে, সংস্কৃতির সঙ্গে যোগটুকু বজায় রাখাটা
পরবর্তী প্রজন্মের কাছে কঠিন হবে না। ছেলেমেয়েদের বড় করা যাবে বিশ্বনাগরিক হিসেবে।
সমস্যাটা ঠিক এখানেই। এই বিষয়টা আসলে নির্ভর করে বাবা মা-র মূল্যবোধের ওপর। বাংলা ভাষায়
তাঁদের আগ্রহের ওপর। সেইসব বাবা মা, যাঁরা বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তাঁরা অনেকে
মনে করেন ছেলেমেয়েরা যখন বিদেশেই থাকবে তখন আর ‘অযথা’ বাংলা ইত্যাদি ‘দেশি’ ব্যাপার
মাথায় ঢুকিয়ে মাথার চাপ বাড়িয়ে আর লাভ কী!
অবশ্য এর উল্টোটাও আছে। বিদেশে
দ্বিতীয় প্রজন্ম, কিন্তু বাংলা ভালবেসে শিখেছেন, সাহিত্য চর্চা করছেন আবার ইউরোপীয়
কিংবা জাপানি একজনকে বিয়ে করে এবং তৃতীয় প্রজন্মকে বাংলা, ইংরেজি, ইউরোপীয় বা জাপানি
ভাষা একসঙ্গে শেখাচ্ছেন আর তারা আনন্দ করে শিখছে- এমন মানুষও আছেন। কিন্তু সংখ্যাটা
হতাশাজনকভাবে কম। অস্বীকার করে লাভ নেই, পরের প্রজন্মকে মাতৃভাষা শেখানোর ব্যাপারে
বিদেশে বসবাসকারী চিন, জাপান, ইতালি কি জার্মানির ছেলেমেয়ে কিংবা দক্ষিণ ভারতীয়দের
তুলনায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। তাই শিকড়র আর সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ অধরাই থেকে যায়
অনেক সময়।
বাংলা ভাষার সঙ্কট
“ফিরে এলাম রাইট আফটার দ্য
ব্রেক। তো যা বলছিলাম, ইউ অল ক্যান টেক পার্ট ইন দ্য ক্যুইজ আর উইন করতে পারো দারুণ
সব প্রাইজেস। বাট্ ফ্রেন্ডস, এই অফার কিন্তু ভ্যালিড টিল ফোর্টিনথ্। সো মনে রেখো...”
কিংবা
“পিকচারটা জাস্ট অসাম্ বস্!”
“কোন পিকচারটা রে?”
“আরে যে পিকচারটা পোস্টালি, এক্ষুণি লাইকেছি তো!”
“থ্যাঙ্কস্ রে! গেটিং ম্যাড ইয়ার্। ব্যাক্ টু ব্যাক্ পরীক্ষা সব। স্কেডিউলটা দেখেছিস?”
“উফ। আর বলিস না। ইট সাকস্!”
ভাবছেন নিশ্চয়ই, এগুলো কী
ধরণের ভাষা?
প্রথমটা বেশিরভাগ ‘বাংলা’ এফ.এম. চ্যানেল-এর ভাষা।
আর দ্বিতীয়টা ‘এখনকার’ এক ধরনের কথা বলার ভাষা। একটু খেয়াল করলে, কান পাতলেই শুনতে
পাবেন ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে এইরকম খিচুড়ি ভাষায় কথা বলছেন অনেকে আর সেটাই নাকি ‘স্মার্টনেস’।
এখন কথা হল, ভাষা তো নদীর
মত। বহমান, পরিবর্তনশীল। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষারও পরিবর্তন হতে পারে। মুশকিল
হচ্ছে, ইদানীং এই যে ‘বাং-লিশ’ বা ‘বাং-হিং-লিশ’, অর্থাৎ বাংলার সঙ্গে ইংরেজি আর হিন্দির
মিলন ঘটেছে সেটা নিয়ে। অনেকেই বলছেন, এ হল ভাষার দূষণ। শুদ্ধ আর মার্জিত বাংলা ভাষা
এভাবে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। আর এ ভাষা শ্রুতিমধুরও নয়।
পাঁচ বছর আগে, ১৯৫২-র ভাষা
আন্দোলনের হীরক জয়ন্তীতে ঢাকা হাইকোর্ট বলেছিলেন:
“বাংলার বিকৃতি চলবে না। বাংলা ভাষার পবিত্রতা রক্ষায় সর্বতোভাবে চেষ্টা করতে হবে।
এ ভাষার উপরে যাতে আর কোনও আঘাত না আসে, সে বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে।”
ভাষা দূষণ ঠিক কোনটা? বাংলায়
অতিরিক্ত ইংরেজি আর হিন্দির ব্যবহারটা দূষণ, না এফ.এম.-এ ইংরেজি টানে (আকসেন্টে) বাংলা
বলাটা দূষণ? নাকি দুটোই?
এত সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা। তবু
বাঙালির এ হীনমন্যতা কেন থাকবে? যেচে ইংরেজির আর হিন্দির আগ্রাসনের শিকার কেন হতে হবে
বাংলা ভাষাকে? কিন্তু আদালতের মাধ্যমে ভাষার শুদ্ধতা রক্ষাও কি সম্ভব? ভাষা মানুষের
একান্ত নিজস্ব ব্যাপার। সেখানে কেউ নিয়ম দেখাতে এলে কিংবা খবরদারি করলে সেটাও কি মেনে
নেওয়া যায়? আর এই যে এত কথা বলছি- সেও তো শুধু বচ্ছরকার এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেই।
বাদবাকি দিনগুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে কী করি আমরা? রক্তের বিনিময়ে অর্জন করা বাংলা ভাষার
পবিত্র অহঙ্কারকে খিচুড়ি ভাষা বলে অমর্যাদা করব না- মনে মনে অন্তত এই সংকল্পটুকু নেওয়া
কি খুব কঠিন?
কোন বাংলা শেখাব?
বাংলা ভাষার আঞ্চলিক রূপের
বিভিন্নতার কথা জানি আমরা। ভাষা। একটা ভাষা শেখা মানে কিন্তু তার ভিন্ন ভিন্ন আঞ্চলিক
রূপ শেখা নয়। একটা ভাষা শেখা মানে হল সেই ভাষার যে রূপটি কাজের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
পেয়েছে এবং যে রূপটি ধরে সেই ভাষার মূল সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে- সেই রূপের ভাষাটি শেখা।
শুধু এপার কী ওপার বাংলা নয়, বিশ্বের সর্বত্র সেটাই দস্তুর। বহু বছর ধরেই কলকাতার যে
বাংলা ভাষা, সেটাই বাংলার সাহিত্য সৃষ্টিতে ও ব্যবহারিক জীবনে মূল বাংলা হিসেবে স্বীকৃতি
ও মান্যতা পেয়েছে। বিদ্যাসাগর আর রবীন্দ্রনাথ-এর হাত ধরে যার বিকাশ হয়েছে সর্বার্থে,
যা আঞ্চলিকতার ছোট ছোট গণ্ডীতে আটকে নেই।
আঞ্চলিক ভাষা আসলে কুয়োর
জলের মত। যত মিষ্টিই স্বাদ হোক তার, সে জল কয়েকটি পরিবারের মধ্যেই আটকে থাকে। আর স্বীকৃত
ও মান্যতা পাওয়া মূল রূপটিই সে ভাষার বহতা নদী। সে নদী কূল ছাপিয়ে যেতে পারে, সাগরে
গিয়ে মিলতে পারে। ছেলেমেয়েদের ভাষা শেখানো মানে এই বহতা নদীর সঙ্গেই পরিচয় করানো। কুয়োর
সঙ্গে নয়।
বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার
চন্দন...
‘বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে
নিকানো উঠোনে ঝরে
রোদ, বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার
চন্দন।’
বাংলা ভাষা আর সংস্কৃতি বাঙালি
হিসেবে আমাদের পরিচয় তৈরি করেছে পৃথিবীর কাছে। এ ভাষা আমাদের অহঙ্কার।
....পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার
আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করিনাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রেও শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।
এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ,
আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।
বাংলা ভাষা নিয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের উত্সব নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু সেখানেই থেমে গেলে মাতৃভাষার
প্রতি ভবিষ্যতের কোন সংকল্প বা দায়বদ্ধতা যোগ হবে না। সেটা বাঙালি হিসেবে আমাদের কাছে
বড় লজ্জার। বাংলা ভাষার প্রতি যে আবেগ আর ভালবাসা- প্রতিদিনের
জীবনে, আমাদের চেতনায় আর মননে সেটা সঙ্গে থাকুক। সারা বছর মাতৃভাষার প্রতি, বাংলা ভাষার
প্রতি সেই ভালবাসাটুকু, হৃদয়ের সেই আর্তিটুকু জীবনীশক্তি হয়ে জেগে থাকুক। পরম মমতায়
অন্তরের উষ্ণতা দিয়ে বাংলা ভাষাকে আগলে রাখুক বিশ্বজুড়ে সমস্ত বাঙালি। অনাগত ভবিষ্যতেও,
বছরের পর বছর, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে।
কবিতা ঋণ: শামসুর রাহমান
সৈয়দ শামসুল
হক