নজরুলের গান : গানের নজরুল
ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায়
ক্যালেন্ডারের সেই তারিখটা ১১ই
জৈষ্ঠ্য এলে তাঁর জন্মদিনে নিজেকে জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়,
কতটা
মনে রেখেছি নজরুলকে ? কি ভাবে মনে রেখেছি
নজরুলকে কিংবা আদৌ মনে রেখেছি কিনা তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্ন আমাদের থাকতেই পারে
কিন্তু একটা উচ্চারণে বোধকরি কোন ভুল নেই যে বাঙালির
– অন্নদা শঙ্কর রায়ের অমর পংক্তি “আর সবই ভাগ হয়ে
গেছে শুধু, ভাগ হয়নিকো নজরুল” । পণ্যায়নের
সর্বব্যাপী থাবার নীচে নজরুল-সৃষ্টি ততটা আলোচিত
নয় এই প্রজন্মের কাছে । পাড়ায় পাড়ায় নজরুল জয়ন্তী পালন বন্ধ হয়েছে অনেকদিন, নজরুলের গানেও দীক্ষিত হচ্ছেন না একালের সংগীত
শিল্পীরা । এই সবই সত্যি । আবার এটাও সত্যি রবীন্দ্রনাথ নামক মহাসাগরের পর বাঙালির
সাহিত্য-সংগীত-সংস্কৃতির
সৃষ্টিভুমিতে নজরুল ছাড়া আর কাকেই বা পেলাম !
রবীন্দ্রনাথ
চলে গেছেন একচল্লিশের ৭ই অগস্ট, আর নজরুলের
অসুস্থতার প্রাথমিক লক্ষণ ধরা পড়ে ঐ দিন থেকেই । নজরুলের কবিতার কথা নাহয় বাদই
দিলাম । কিন্তু নজরুলের বাকরুদ্ধ হওয়ার পঁচাত্তর বছর পরেও অন্তত বাংলা গানের
ক্ষেত্রে নজরুলকে সরিয়ে দেবার মত কাউকেই তো পেলামনা !
বস্তুত গানের নজরুল এক বিস্ময়কর
প্রতিভা । কাব্যের নজরুলের নির্মোহ আলোচনা কম হয়নি । রবীন্দ্র-উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আধুনিক কবি জীবনানন্দ দাস
মনে করেছিলেন “তাঁর কবিতা চমৎকার কিন্তু
মানোত্তীর্ণ নয়” । অবশ্য একথাও জীবনানন্দ বলেছিলেন যে “...
এরকম
পরিবেশে হয়তো শ্রেষ্ঠ কবিতা জন্মায় না কিংবা জন্মায়,
কিন্তু
মনন প্রতিভা ও অনুশীলিত সুস্থিরতার প্রয়োজন । নজরুলের তা ছিল না” । নির্ভুল মূল্যায়ন
। শৈশব থেকে দারিদ্রের মুখোমুখি হয়ে মাত্র ৯বছর বয়সে পিতৃহারা নজরুল তাঁর বহুমুখী
সৃজনশীলতা পাখনা মেলার মত আকাশের সন্ধান পেলেন না । ১৯১৯ থেকে ১৯২৮ - নজরুলের কাব্যজীবনের এই ৯ বছরের সময়কালেও কবেই বা
সুস্থিতি পেয়েছিলেন তিনি ! করাচির সেনানিবাসের
পাট চুকিয়ে ফিরে এলেন ২০বছর বয়সে, দেশ তখন উত্তাল ।
সদ্যগঠিত কম্যুনিষ্ট পার্টির সংঠন, কৃষক সমিতি, সাংবাদিকতা, স্থায়ী থাকার জায়গা
নেই, উপার্জনের ব্যাবস্থা নেই ।
কাব্যসাধনার জন্য সুস্থিতি পাবেন কি করে ? এর সঙ্গে ছিল
পত্রিকা সম্পাদনার ধকল, মৌলবাদী হিন্দু – মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আক্রমণ,
কারা
বরণ । তথাপি বিস্ময়কর এই যে কি অমিত ঐশ্বর্য দান করে গিয়েছেন সেদিনের তরুণ
প্রজন্মের কাছে । দেশ ও সমাজ প্রেম তাঁর কাব্যে মুক্তকন্ঠ সুস্পষ্টতা পেয়েছিল ।
সমবয়সী ভিন্ন ধারার কবি জীবনানন্দ দাস যেমন বলেছিলেন “ভাষা,ভাব বিশ্বাসের আশ্চর্য যৌবন রয়েছে এই কবিতাগুলির ভিতর”।
সুস্থিত হলেন তখন যখন তিনি ‘গানের নজরুল’ । যখন তিনি সুরের
রাজা হয়ে আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ নির্মাণের প্রস্তুতি
সারছেন
। গান তাঁর ঝোড়ো জীবনেরও প্রধান সঙ্গী ছিল । গান তো নয় – দেশাত্মবোধের
চারণমন্ত্র । ১৯১৯এ নেতাজি সুভাষচন্দ্র স্মৃতিচারণ করেছিলেন “আমরা যখন যুদ্ধে
যাবো, তখন সেখানে নজরুলের যুদ্ধের গান
গাওয়া হবে । আমরা যখন কারাগারে যাবো, তখন তাঁর গান গাইবো”
। গান তিনি ছেলেবেলা থেকেই গাইতেন,
সুর
করতেন । ১৯২০তে করাচির সেনানিবাস থেকে ফিরে আসার পর গান শুনিয়েই জয় করে নিয়েছিলেন
কলকাতার বিদগ্ধ মহলকে । সভা-সমিতি কিংবা ঘরোরা
সাহিত্য আড্ডায় তাঁর গানই থাকতো প্রবল আকর্ষণের কেন্দ্রে । নানান বিদগ্ধজনের
স্মৃতিকথায় নজরুলের আপনভোলা গানপাগল মূর্তিটির ছবি লেখা আছে । মুজফফর আহমেদ
লিখেছেন ‘কারখানার শ্রমিকরা পর্যন্ত ডেকে
নিয়ে যেতেন নজরুলকে’। বুদ্ধদেব বসু তাঁর স্মৃতিচারণে
জানিয়েছেন ‘নজরুল যে ঘরে ঢুকতেন সে ঘরের
সবাই ঘড়ি দেখতে ভুলে যেতেন’ । অথচ প্রথাগত কোন সংগীত শিক্ষা
তাঁর ছিল না । বাল্যেই পিতৃহারা, লেটোর দলে গান
গাওয়া, পাঊরুটির কারখানায় কাজ করা
কিংবা রেলের গার্ড সাহেবের ঘরে ফরমাস খাটা নজরুলের সামনে সে সুযোগ আসেনি । যেমন
ছিলনা তাঁর কোন প্রথাগত ছাত্রজীবন । লেটোর দলে ঘুরে বেড়ানো বাউন্ডুলে নজরুল বাংলার
মাটি থেকে তামাম লৌকিক সুর আত্মস্থ করেছিলেন । কিন্তু তাঁর সাংগীতিক প্রতিভার পটভুমি
কিভাবে নির্মিত হয়েছিল তার কোন লেখাজোখা নেই । নজরুল স্মৃতির সবচেয়ে বিশ্বাস্য
সূত্র মুজফফর আহমেদ তাঁর স্মৃতিকথায় জানিয়েছেন যে কলকাতায় আসার পর রবীন্দ্রসংগীতই
তাঁর পরিবেশনের শীর্ষস্থানে থাকত । তিনি নজরুলকে ‘রবীন্দ্র সংগীতের
হাফেজ’ বলতেন । চুরুলিয়ার বাউন্ডুলে কৈশোর
জীবনে কিংবা করাচির সেনা নিবাসে রবীন্দ্রনাথের গান কি করে আয়ত্ব করেছিলেন নজরুল, এ বড় বিস্ময় ! বাল্য ও কৈশোরে
শুধু লেটোর দলের গানই নয়,কবিগান, ঢপ, কীর্তন, আখড়াই, ভাদু, মনসার গান,কাওয়ালি,ঝুমুর, পাঁচালি ইত্যাদি
লোক আঙ্গিকের গান তিনি আত্মস্থ করেছিলেন যা পরবর্তী সময়ে ‘গানের নজরুল’কে নির্মাণ করেছিল ।
১৯২৮এ নজরুল কাব্যজগৎ থেকে
স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিয়ে চলে এলেন গানের
ভুবনে । গ্রামফোন কোম্পানীর মাসমাইনের গীতিকার –
সুরকার-কম্পোজার-ট্রেনার সব দায়িত্ব
। গ্রামফোন কোম্পানীর বাংলা গান রেকর্ডিংএর প্রধান । ১৯৩৩এ প্রকাশিত রুবাইৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ গ্রন্থের ভুমিকায় নজরুল জানালেন “
কাব্যলোকের
গুলিস্তান থেকে সংগীতলোকের রাগিনী দ্বীপে আমার নির্বাসন হয়ে গেছে” । সংগীতের সবক’টি বিভাগই নজরুলের জাদু স্পর্শের ঐশ্বর্য পেয়েছিল ।
নানান বাদ্যযন্ত্রের পারদর্শিতা, গান গাওয়া, গান লেখা, সুর করা, থিয়েটার ও সিনেমার সংগীত পরিচালনা এমনকি একটি সিনেমায়
ভক্ত ধ্রুব চরিত্রে অভিনয়ও করেছিলেন । মাত্র এগারো বছরের সাংগীতিক জীবনে
অবিশ্বাস্য তিনহাজারেরও বেশি গান লিখেছিলেন আর তাঁর গানের রেকর্ডের সংখ্যা ১৭০০ । রাগাশ্রয়ী আধুনিক গান, প্রেম সংগীত, ছোটদের গান, কীর্তন, আগমণি, শামা সংগীত, গজল, কাওয়ালি, ইসলামি গান – সব ধরণের গান ।
একথা বললে অতিউক্তি হবে না যে, নজরুলের সাংগীতিক প্রতিভাকে ভর করেই গ্রামফোন কোম্পানী
বাংলা গানের বিপণন ব্যবসাকে প্রথম পোক্ত করতে পেরেছিল । এদেশে প্রথম গান শোনার
যন্ত্র বা কলেরগান আসে ১৯০০ সাল নাগাদ এবং ১৯০২এ প্রথম বাংলা গানের রেকর্ড হয়
তখনকার থিয়েটার দলে সখীর নাচের দলের দুই বালিকাকে দিয়ে । পরিশীলিত গায়ন রুচি তৈরী
হতে লেগে গেছে আরো বিশ/পঁচিশ বছর । তখন
বাংলা গান বলতে কিছু রাগাশ্রয়ী গান, চটুল দেহতত্বের গান, কীর্তন,ভজন ইত্যাদি ।
বাঙালির গান শোনার কান সবে তৈরী হতে শুরু করেছে । কলকাতা বেতার ব্যবস্থা সবে শুরু
হয়েছে ১৯২৭এর ১৬ই অগস্ট, বাংলা চলচ্চিত্র
তখনও নির্বাক । ঠিক এই সময়েই অসামান্য সাঙ্গীতিক প্রতিভা নজরুলকে ‘শিকার’ করলো গ্রামফোন
কোম্পানী । নজরুলেরও স্থায়ী উপার্জনের প্রয়োজন ছিল।
কলের
গানের বণিক নিংড়ে নিলো নজরুলকে । সেই সময় নজরুলের লেখা এবং তাঁর প্রশিক্ষণে গান
রেকর্ড করার জন্য লাইন পড়ে যেতো, কারণ তাঁর রচনা ও
সুর মানেই ছিল সেই শিল্পীর অবধারিত সাফল্য ও লোকপ্রিয়তা । তিরিশের দশকে সেকালের
প্র্মুখ শিল্পীরা – আঙ্গুরবালা, ইন্দুবালা, কমলা ঝরিয়া,কাশেম মল্লিক,আব্বাসউদ্দীন, যুথিকা রায়, মৃণালকান্তি ঘোষ,ধীরেন দাস, ফিরোজা বেগম, সুপ্রভা সরকার এবং আরো অনেকেই নজরুল গানের সার্থক
শিল্পী রূপে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন । এঁরা
সকলেই নজরুলের প্রশিক্ষণে গ্রামফোনে গান গেয়েছেন । বস্তুত রবীন্দ্রগানের বাইরে আধুনিক বাংলা
রেকর্ডের গানে কাব্যের লাবণ্য ও পরিশীলিত গায়ন ভঙ্গি প্রথম নিয়ে এসেছিলেন নজরুলই ।
চল্লিশ থেকে ষাট দশক পর্যন্ত যে সময়কালকে আমরা বলি বাংলা গানের স্বর্ণযুগ । সেই
স্বর্ণযুগের গানের জলসায় তিনি নেই । কিন্তু সংশয়ের যায়গা নেই এই স্বর্ণযুগের
প্রস্তুতিপর্ব সারা হয়েছিল নজরুলের হাতেই ।
রবীন্দ্রনাথ নিজের গানের
ভবিষ্যৎ দেখেছিলেন – বলেছিলেন ‘বাঙালিকে সুখে দুঃখে আমার গানই গাইবে, এ গান তাদের গাইতেই
হবে’ । নজরুলও তেমনই
আত্মপ্রত্যয়ী ছিলেন । ১৯৩১এ জনসাহিত্য
সংসদের অধিবেশনের ভাষণে নজরুল আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছিলেন “সাহিত্যে দান আমার
কতটুকু তা আমার জানা নেই, তবে এটুকু মনে আছে, সংগীতে আমি কিছু দিতে পেরেছি । সংগীতে যা দিয়েছি সে
সম্বন্ধে আজ কোন আলোচনা না হলেও ভবিষ্যতে যখন আলোচনা হবে তখন আমার কথা সবাই মনে
করবেন – এ বিশ্বাস আমার আছে” ।
রবীন্দ্রনাথের
গানের কথা ও সুর সংরক্ষণের বন্দোবস্ত ছিল, শান্তিনিকেতন ও
বিশ্বভারতীর প্রয়াসে রবীন্দ্রনাথের গান পেয়েছে এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ কিন্তু
নজরুলের গানের ক্ষেত্রে তা হয়নি । নজরুলের বহু গানের কথা ও সুর হারিয়ে গেছে, অনেক নজরুল ভক্ত তাঁর গানকে নিজের গান বলেও চালিয়ে
দিয়েছেন একথাও শোনা যায় । নজরুলের অনভিজাত দিলখোলা জীবন যাপনই এরকম সুযোগ করে
দিয়েছিল । দু খিলি জর্দাপান খাইয়েই নাকি গান লিখিয়ে নেওয়া যেত তাঁকে দিয়ে ।
গানের জগতে নজরুল ছিলেন মাত্র
বারো বছর, আর এই অল্প সময়কালেই, বিপণনযোগ্য বাংলা গানের ভুবনকে শাসন করেছেন, ধারে কাছে কেউ ছিলেন না । রবীন্দ্রনাথও নয় । সত্য বটে, নজরুলের গানে রবীন্দ্রনাথের গানের মত আলোক সামান্য
নান্দনিক স্পর্শ ছিল না । তাঁর গান ছিল স্বতস্ফূর্ত,
সরল, আবেদনে প্রত্যক্ষ আর তাই শিক্ষিত,
আশিক্ষিত
সকলকেই স্পর্শ করে তাঁর গান । আধুনিক বাংলাগানের ক্ষেত্রে নজরুল জনপ্রিয়তার শিখরে
উঠলেন আর এই সূত্রেই বাংলার বিদগ্ধ মহল ও তাঁর কবি বন্ধুদের কাছ থেকে পেলেন
উপেক্ষা । তাঁরা অনেকেই দূরে সরে গেলেন । গ্রামফোন কোম্পানীর বেতনভোগী চাকুরে, বণিক কোম্পানীর নির্দেশমত হালকা চটুল গানের নির্মাণও
তাকে করতে হয়েছিল পেটের দায়ে । বাংলা সংগীতের ভান্ডারকে নজরুল ঐশ্বর্যমন্ডিত
করেছেন, কিন্তু গ্রামফোন কোম্পানীর
বানিজ্যিক স্বার্থ মেটাতে গিয়ে কম মূল্য চোকাতে হয়নি নজরুলকে । সেই মূল্য তাঁর
সমাজসচেতন গণমুখী কাব্যচেতনার সঙ্গে চির বিচ্ছেদ ।
ইসলামী
গান, বাংলা গজল গানের জন্য বিরূপ
হয়েছিলেন হিন্দুরা, তাঁর কবিবন্ধুরা আর শ্যামা
সংগীত গান রচনার জন্য বিধর্মী আখ্যা পেয়েছিলেন মৌলবাদী মুসলিমদের কাছ থেকে । গানের
নজরুলের কাছ থেকে তাঁর বন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া বা রেকর্ড কোম্পানীর দাসত্ব মেনে
নেওয়া নজরুলকে গ্লানিবোধে আক্রান্ত ও বিষাদগ্রস্ত করেছিল সেকথাও আমরা জানি ।
রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি পত্রে নজরুল লিখেছিলেন “গুরুদেব, বহুদিন আপনার শ্রীচরণ দর্শন করিনি । আমার ওপর হয়তো
প্রসন্ন কাব্যলক্ষী হিজ মাস্টার্স ভয়সের কুকুরের ভয়ে আমাকে ত্যাগ করেছেন । কাজেই
সাহিত্যের আসর থেকে আমি প্রায় স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছি । ...
আমার
এক নির্ভিক বন্ধু আমাকে উল্লেখ করে একবার বলেছিলেন যাকে বিলিতি কুকুরে কামড়েছে
তাকে আমাদের মাঝে নিতে ভয় হয় । সত্যি ভয় হবারই কথা,
তবু
কুকুরে কামড়ালে লোকে নাকি ক্ষিপ্ত হয়ে অন্যকে কামড়াবার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে । আমার
কিন্তু সে শক্তি নেই, আমি হয়ে গেছি বীষ
জর্জরিত নির্জীব” । (সূত্র –
‘অঞ্জলী লহ মোর সংগীতে’ / অরুণ কুমার বসু , ‘পুরশ্রী’ পত্রিকা, জুলাই ১৯৯৯ ) । আর্থিক অসাচ্ছল্য, পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যু,
নিকটজন
ও কবিবন্ধুদের দূরে সরে যাওয়া, স্ত্রী প্রমিলার
পক্ষাঘাতে শয্যাশায়ী হয়ে পড়া নজরুলকে ভেতরে ভেতরে ক্লান্ত,
বিষাদগ্রস্ত
করেছিল । কিন্তু সেই ক্লান্তি, বিষাদের
বিন্দুমাত্র ছায়াপাত তাঁর সংগীত সৃষ্টিতে পড়েনি । শুধু অফুরন্ত দিয়ে গেছেন বাংলা
গানের ভান্ডারে । ভেতরের ক্ষয় গোপন করে শুধু রাশি রাশি দিয়ে গেছেন ।
গ্রামফোন রেকর্ডের গান
নিশ্চিতভাবেই ‘গানের নজরুলের’ সামগ্রিক পরিচয় নয় । তাঁর জাগরণের গান, যৌবনের গান প্রজন্মের পর প্রজন্মের কাছে প্রবাদের মত
হয়ে আছে । সেখানে আজও তাঁর আসন অটল । নজরুলের সচেতন সৃষ্টির সময়কালই তো মাত্র
২১বছরের – ১৯২০ থেকে ১৯৪১ । ১৯৪২এর অগস্ট-সেপ্টেম্বর থেকে তিনি যখন বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তখন
তাঁর বয়স সবে বিয়াল্লিশ । ফুলের জলসায় নীরব কবি বেঁচেছিলেন আরো ৩৫ বছর । ১৯৭৬এর ২৯শে অগস্ট নজরুলের দেহাবসান হয় । সে তো তাঁর
দেহের মৃত্যু । নজরুল ইসলাম বেঁচে
আছেন, বেঁচে থাকবেন মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের
মর্যাদায় । বাংলার শেষ চারনকবি নজরুলের
গান কিংবা গানের নজরুল সম্পর্কে কথা সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের মন্তব্যের
উদ্ধৃতি দিয়ে উপসংহার টানি এই নিবন্ধের – “...দুঃখের পথে আর এক
পাথেয় নজরুলের গান । বুকভরা, কন্ঠভরা গান ।
অপরাজিত প্রাণের আনন্দিত উদার জলোচ্ছ্বাস – রাত্রির সীমান্তে
প্রভাতী পাখির কলধ্বনি” । (‘নজরুল স্মৃতি’)
(পুণঃপ্রকাশ- সৌজন্যঃ 'ঋতবাক' মে ২০১৬)