একুশের বাংলাভাষা
প্রতিবছরই আসে একুশে ফেব্রুয়ারী। একুশের সাথে বাংলা ভাষার যে নাড়ির সংযোগ, সেই সংযোগের ঐতিহাসিকতা নিয়ে কোন বিতর্ক নাই। বিতর্ক সেই সংযোগের বর্তমান অবস্থা নিয়ে। বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের মূল অভিমুখ ছিল জীবনজীবিকার প্রশ্নে বাংলাভাষার গুরুত্বকে সুরক্ষিত করার অধিকার অর্জন। তারপর কেটে গিয়েছে সাতটি দশক। ঘটে গিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ। আত্মপ্রকাশ করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ। সেও আজ থেকে পাঁচ দশক আগে। স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্র ভাষা আজ বাংলা। ঠিক যে অধিকারের দাবিতেই বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলনের সূচনা। সেই অধিকার অর্জন করে নিয়েছে আজকের বাংলাদেশ। একটি দেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে এই একুশের উদযাপন। খুব ভালো কথা। যে উদযাপনের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিস্বরূপ একুশ আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একজন বাঙালি হিসাবে, আজ গর্বের দিন। আজ আনন্দ উদযাপনের দিন। কিন্তু আজ হিসাব নিকাশের ব্যালেন্সশীট মেলানোরও দিন।
বাংলা ভাষা, বাঙালির মুখের ভাষা। সেই বাঙালি আজ বিশ্বের সব চেয়ে ছন্নছাড়া জাতি। কথাটা অনেকেরই মনঃপুত হওয়ার নয়, ঠিক। কিন্তু এটি এক বাস্তব সত্য। বাঙালির নিজস্ব দেশ বলতে একটুকরো বাংলাদেশ। প্রায় সম পরিমাণ বাঙালি অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাধিক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে সেই সেই রাষ্ট্রের অধীন। এক ভারতবর্ষেই বাঙালি একাধিক জাতির সাথে তাদের ভাষা ও কৃষ্টির সাথে ভারতীয় নাগরিক হিসাবে জীবন যাপন করছে। তার ভিতরে পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় বাঙালিই এখন পর্যন্ত শাসনভার পরিচালনায়। তবে সেই ধারাবাহিকতা কতদিন অটুট থাকবে সেবিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। অবিভক্ত বাংলার এক বিস্তৃত ভুখণ্ড ব্রিটিশ শাসনকালেই আসামের সাথে যুক্ত করে দেওয়ায় আজকের গোয়ালপাড়া শিবাসগর কাছাড় সহ গোটা বরাক উপত্যাকাই আসামের অধীনে। অসমীয়া জাতিগোষ্ঠীর ধারণায় এই সব অঞ্চলের বাঙালিরা সকলেই বিদেশী। ফলে আসামে ঢুকে যাওয়া অবিভক্ত বাংলার বিস্তৃত অংশের বাঙালিই আজ প্রবাসী বাঙালির পরিচয়ে বেঁচে রয়েছে। ইতিহাসের কি নিদারুণ তামাশা। এবং আরও দুঃখের বিষয়, ১৮৭৪ সালের বঙ্গভঙ্গ এবং তার ফলে অবিভক্ত বাংলার এক বিস্তৃত অঞ্চলকে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়ার ইতিহাস আজ অধিকাংশ বাঙালিরই জানা নাই। জানা নাই সেই সেই অঞ্চলের চৌদ্দো পুরুষ ধরে বসবাস করা বাঙালিকে আজ আসামের অধীনে প্রবাসী বা বিদেশী বাঙালি হিসাবে পরিচিত হয়েই জীবনরক্ষা করতে হচ্ছে। অনেকেই জানেন না, আজকের বিহার ও ঝাড়খণ্ডের পূর্বপ্রান্তের অধিকাংশ অঞ্চলই ব্রিটিশের আগমনের আগে থেকেই বাঙালির নিজের জনপদ ছিল। ছিল অবিভক্ত বাংলারই অংশ। মানভুম সিংভুম রাঁচী ধানবাদ ভাগলপুর পূর্ণিয়া ছিল অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম অংশ। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই অঞ্চলগুলি বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেও অঞ্চলগুলি স্বাধীনতার সময় অব্দিও বাঙালি অধ্যুষিত ছিল। স্কুল কলেজ পাঠাগার অধিকাংশই ছিল বাংলায়। জনপদের মুখের ভাষা প্রধানত ছিল বাংলা। কিন্তু স্বাধীনতার পর রাজ্যের সীমা বন্টনের সময় থেকে প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থার অধীনে দিনে দিনে এই সকল অঞ্চলে বাংলা ও বাঙালির প্রভাব কমতে শুরু করে। হাজার বছরের বাংলার ভুখণ্ডের অংশ ও তার সমাজিক বিন্যাসের ধারা দশকের পর দশকে বিহার ও আজকের ঝাড়খণ্ডের আঞ্চলিক সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে যেতে থাকে। সমাজিক ভাবেই, রাজনৈতিক মানচিত্রকে শিরোধার্য্য করে। দক্ষিণে উড়িষ্যার কটক অব্দিও বাঙালির জনপদ বিস্তৃত ছিল। সেই অঞ্চলও আজ বাংলার হাতছাড়া। আসাম বিহার উড়িষ্যার ভিতরে ঢুকে যাওয়া এই সকল অঞ্চলে ভাষা হিসাবে বাংলার অস্তিত্ব কেবলমাত্র খাতায় কলমে ভারতের একটি ভাষা হিসাবেই। এমনকি অধিকাংশ বাঙালিই সেখানে বাংলায় লিখতে পড়তে সক্ষম কতটা সেই বিষয়ে যথেষ্ঠ সন্দেহ রয়েছে। বাংলা মাধ্যমের স্কুল কলেজ পাঠাগার সব অবলুপ্তির পথে। সমাজিক কিংবা সরকারী কাজে বাংলার কোন স্থান নাই। বাঙালি রয়েছে কিন্তু বাংলা নাই।
দেশভাগের বলি বাঙালির একটা বড়ো অংশ আজকের ছত্তিশগড়ের বাসিন্দা। বিগত আট দশকে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি সবই বদলিয়ে গিয়েছে। বদলিয়ে গিয়েছে আন্দামানে আশ্রিত বাঙালি উদ্বাস্তুদেরও ভাষা ও সংস্কৃতি। দেশভাগের ফলে আসামে আশ্রয় নেওয়া বাঙালিদেরও দশাও অনেকটা প্রায় সেইরকমই। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইংল্যাণ্ড ছাড়িয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র কানাডা অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যাণ্ড দখল করে স্থায়ী ভাবে বসে গিয়েছে কয়েক শতাব্দি হলো। কিন্তু এই সকল প্রতিটি দেশই আজ তাদেরই দখলে। সেই ইংরেজি ভাষা ও সংস্কৃতির নিয়ন্ত্রণে। ফলে জাতি হিসাবে ইংরেজরা একাধিক রাষ্ট্রের নাগরিক হলেও প্রতিটি রাষ্ট্র তাদেরই দখলে। তাদেরই ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচালনায়। অথচ অবিভক্ত বাংলার কেবলমাত্র একটি টুকরোই আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। এবং বাংলা যার রাষ্ট্র ভাষা।
একুশের হিসাব নিকাশের ব্যালেন্সশীট মেলাতে বসলে আগে এই পটভুমি সম্বন্ধে সচেতন থাকতে হবে। বাংলাদেশর বাইরে পূর্বতন অবিভক্ত বাংলার কোন অংশেই কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা, এখনো যে দুটি অংশে বাঙালিই রাজনীতি ও সমাজের পুরোধায় থেকে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনায় রয়েছে, সেখানেও রাষ্ট্রভাষা বাংলা নয়। কারণ এই দুইটি প্রদেশ ভারতবর্ষের অধীনস্ত। বাকি অংশগুলি পশ্চিম ও দক্ষিণ আসাম, পূর্ব বিহার, পূর্ব ঝাড়খণ্ড ও উড়িষ্যার উত্তরে অবস্থিত। ফলে সেই সেই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতির অধীনস্ত। ফলত রাজনৈতিক মানচিত্র অনুসারে একমাত্র বাংলাদেশেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ঠিক যেমন ইংল্যাণ্ড, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যাণ্ডের রাষ্ট্রভাষা ইংরেজি। বাকি অংশে বাংলা ভাষা আজ মৃতপ্রায়। অবলুপ্তির পথে। শুধুমাত্র একুশের উদযাপনেই বাংলাভাষার স্মরণ অনুষ্ঠান।
কিন্তু একটি ভাষার অস্তিত্বের পিছনে রাষ্ট্রভাষার অধিকার প্রাপ্তিই কি যথেষ্ঠ? মনে হয় না। না পেলে তো কথাই নাই। কিন্তু পেলেই যে সেই ভাষা স্বমহিমায় বিকশিত হয়ে উঠবে, এমন কোন কথা নাই। যদি কোন ভাষা মানুষের জীবনজীবিকাকেই নির্ভরতা দিতে না পারে, তবে সেই ভাষার অস্তিত কালক্রমে অবলুপ্তির অভিমুখেই হাঁটতে থাকবে। ব্রিটিশের শাসন কাল থেকেই বাঙালির মনে একটি বদ্ধমূল ধারণা জন্ম নিয়েছে। ইংরেজি ভাষা না জানলে শিক্ষিত হওয়া যায় না। অসম্ভব। প্রায় চোখ বুঁজে বলে দেওয়া যায়, একশ জন বাঙালির কাছে জানতে চাইলে, এই একটিই উত্তর পাওয়া যাবে। ইংরেজি না শিখলে শিক্ষিত হওয়া সম্ভব নয়। কি অশিক্ষিত কি অর্দ্ধ শিক্ষিত কি উচ্চ শিক্ষিত। সকলেই এই বিষয়ে একমত। যেকোন জাতি যখন এমন একটি ধারণায় বদ্ধমূল বিশ্বাসী হয়ে ওঠে। যে বিশেষ কোন একটি বিদেশী ভাষা না শিখতে পারলে শিক্ষিত মানুষ হয়ে ওঠা যায় না। সেই জাতির মাতৃভাষা দিনে দিনে অবলুপ্তির দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য। শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা করে সেই ভাষাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। এর মূল কারণটা হলো এই, একটা গোটা জাতি ও তার সমাজ যখন এই বিশ্বাসে গড়ে ওঠে, তখন জীবনজীবিকার ক্ষেত্রে সে তার নিজের মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলে। যেকোন কালে যেকোন দেশে যেকোন জাতির মাতৃভাষা যদি তার জীবনজীবিকার ক্ষেত্রেই বাধা হয়ে দাঁড়ায়, কোনরূপ নির্ভরতা দিতে না পারে। ভরসা দিতে না পারে, তবে সেই মাতৃভাষার অবলুপ্তি অবধারিত।
আজকের বাঙালি, সে বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন। একটা বিষয়ে এক। সেটি হলো, আপন সন্তান সন্ততির শিক্ষার জন্য মাধ্যম হিসাবে বাংলাভাষা অচল। তাই কি ধনী কি দরিদ্র যেভাবেই হোক অধিকতর কষ্ট স্বীকার করে হলেও নিজের ছেলে মেয়েদেরকে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ভর্তি করতে চেষ্টা করে। প্রাণপণে। তারা জানে ইংরেজি না জানলে কোন শিক্ষাই কাজে দেবে না। তাদের বিশ্বাস ইংরেজি মাধ্যম ছাড়া কোন বিদ্যা অর্জন সম্ভব নয়। আর, সমাজটা দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। ইংরেজি জানা আর ইংরেজি না জানা। প্রথম শ্রেণীটি সামজিক এলিট। সকল সুবিধা ননীমাখন তাদের অধিকারে। আর দ্বিতীয় শ্রেণীটি অন্ত্যেজ। সকল সুবিধা ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। তাই বাবা মা কিংবা অভিভাবকরূপে সকলেই আপন সন্তানকে ইংরেজিতে শিক্ষিত করতে উঠেপড়ে লেগে গিয়েছে। এই চিত্র কাঁটাতারে খণ্ড বিখণ্ড অবিভক্ত বাংলার সকল অংশেই। এই যে এক নতুন ধারা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মাতৃভাষা বাংলা থেকে দূরবর্তী থেকে জীবনজীবিকার অভিমুখে এগিয়ে চলেছে, তাদের হাত ধরে একদিন বাংলার সাহিত্য সঙ্গীত সংস্কৃতির মূল ধারা শুকিয়ে যাওয়া জনশূন্য নদীর মতে মরে পড়ে থাকবে। আর যারা ইংরেজি না শিখতে পারায়, আপন মেধার বিকাশ সাধনে ব্যর্থ হয়ে দারিদ্র্যের সাথে লড়াই করতে করতে জীবন যুদ্ধে বিপর্যস্ত হতে থাকবে, তাদের হাতেও বাংলার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ধারাকে পুষ্ট করে রাখার কোন জাদুদন্ড থাকবে না।
বাঙালি মাত্রেই একটি বিষয়ে অসচেতন। অশিক্ষিত। কোন জাতি তার মাতৃভাষাকে বাদ দিয়ে সামগ্রিক উন্নতি ও জাতির বিকাশ সাধন করতে পারে না। মানুষের ইতিহাসে আগেও কোনদিন পারেনি। পরেও কোনদিন পারবে না। যেটা পারবে, সেটি হলো সমাজে একটি এলিট সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করা। জার আমলের রাশিয়ায় ফরাসী জানা রাশিয়ান এলিট সম্প্রদায়ের মতো। রাশিয়ান বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে রাশিয়া জাতি হিসাবে সেই অভিশপ্ত কাল ও মানসিকতার গণ্ডী ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। রাশিয়ার উন্নতির শুরু তারপর থেকেই। ইতিহাস সম্বন্ধে অনাগ্রহী বাঙালি আজও এই সরল সত্যটুকু বুঝতে চায় না। মনেও হয় না অদূর ভবিষ্যতেও চাইবে।
এবারে আরও একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক বরং। যে কোন সমাজেই ধর্ম মানুষের ব্যক্তি জীবন ও গোষ্ঠী জীবনে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে থাকে। দেশ কাল সম্প্রদায় নির্বিশেষে। ধর্মের নিরিখে বাঙালি আজ মূলত দুইটি প্রধান সম্প্রদায়ে বিভক্ত। হিন্দু ও মুসলিম। কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ ও খৃষ্টান সহ। হিন্দু বাঙালির ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ভাষা কিন্তু বাংলা নয়। সংস্কৃত। যা কোন বাঙালির মুখের ভাষাও নয় মাতৃভাষাও নয়। বাঙালি মুসলিমের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের ভাষা আরবী। সম্পূর্ণ ভাবেই একটি বিদেশী ভাষা। মধ্য প্রাচ্যের এই ভাষাটির সাথে বাংলা ও বাঙালির নাড়ির যোগ নাই। এটিও বাঙালির মুখের ভাষা বা মাতৃভাষা নয়। ঠিক একই রকম ঘটনা বাঙালি বৌদ্ধ বাঙালি খৃষ্টানদের জীবনেও। একজন বাঙালিও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যে এমন উদ্ভট কাণ্ড সম্বন্ধে সচেতন। একটা সমগ্র জাতি। একাধিক সম্প্রদায়ে বিভক্ত। একাধিক ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবে অভিন্ন। সেই অভিন্নতায় সকল সম্প্রদায়ই কোন না কোন বিদেশী ভাষায় তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। অর্থাৎ মন্দির মসজিদ মঠ গীর্জায় পা রাখার আগে, বাঙালি মাত্রেই আপন মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে তবে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে অগ্রসর হয়। নিষ্ঠা ভরে। ব্যক্তি জীবন ও সমাজিক জীবনে সামগ্র জাতির অভিমুখ যখন এই দিশায় চলতে থাকে তখন সে বড়ো সুখের কথা নয়। একজন মানু্ষের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনেই যদি তার আপন মাতৃভাষা ব্রাত্য হয়ে পড়ে থাকে, তবে সেই ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কোনভাবেই তার আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না। বাইরের পোশাকের মতো একটা খোলস হয়ে ওঠে। যে খোলসের ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ সময় কাটানোই ধর্ম পালনের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। ব্যক্তি মানুষ তার অন্তরাত্মায় সেই ধর্মকে আর তখন ধারণ করতে পারে না। এই যে অক্ষমতা, এই অক্ষমতাই বাঙালিকে অন্তঃসারশূন্য এক ফাঁপা সত্বায় অবরুদ্ধ করে রেখেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যাপী। এই ঘটনাই প্রমাণ করে, যে বাঙালি সবচেয়ে বেশি ধর্ম ধর্ম করে সরব। সেই বাঙালিই আসলে ধর্মচ্যুত। কোন ধর্মই তার অন্তরাত্মার আত্মীয় নয়। আপন মাতৃভাষাই যদি প্রতিদিনের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে ব্রাত্য হয়ে পড়ে থাকে, তবে সেই আচার অনুষ্ঠান আর যাই হোক ব্যাক্তি মানুষের আধ্যাত্মিক বিকাশে কোন কাজেই আসে না। তাই বাঙালিরও আসে নি।
আশা করা যেতে পারে পাঠকের কাছে সামগ্রিক ছবিটা ধীরে ধীরে সুস্পষ্ট হয়ে উঠছে। আজকের বাঙালি। হিন্দু কিংবা মুসলিম। বৌদ্ধ কিংবা খৃষ্টান। ধনী কিংবা দরিদ্র। শিক্ষিত কিংবা অশিক্ষিত। এলিট কিংবা বঞ্চিত। তার ব্যক্তি জীবনেই ধর্ম, শিক্ষা, জীবিকা, পেশা, সর্বক্ষেত্রেই আপন মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে বসে রয়েছে। বাংলা মাধ্যমের কয়েকজন শিক্ষক আর বাংলা ভাষার সাহিত্যিক গায়ক গায়িকা নটনটী বাদ দিলে এটাই বাঙালির প্রতিদিনের ব্যক্তি জীবনের মূল চিত্র। জীবনের মূল দিগন্তগুলিতেই আমরা বাংলা ভাষাকে কার্যত বাদ দিয়ে বসে রয়েছি। এটাই জাতি হিসাবে বাঙালির ঐতিহ্য ও একমাত্র উত্তরাধিকার। প্রাক ব্রিটিশ যুগেও ধর্ম শিক্ষা ও পেশাগত জীবনে বাংলাভাষার কোন স্থান ছিল না। ব্রিটিশ আমলেও সেই ধারা বজায় ছিল। পরিবর্তন হিসাবে শিক্ষা ও জীবিকা, বাণিজ্য ও গবেষণা এবং আইন আদালত বিচার ব্যাবস্থায় ইংরেজি এসে জুড়ে বসলো। ইংরেজির সেই একাধিপত্য আজও অটুট। স্বাধীনতার পরপর কয়েক দশক বাংলাচর্চার দিগন্ত কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল, সেকথাও সত্য। কিন্তু একবিংশ শতকের শুরু থেকেই বিশ্বায়নের ধামাকায়, সেই ঔজ্জ্বল্য আজ ম্রিয়মান। আজ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে সংস্কৃত ও আরবী। বাকি সব দিগন্তেই ইংরেজিই একমাত্র গতি। বাংলাভাষার জন্য তাহলে পড়ে রইল কিঁ? গল্প কবিতা উপন্যাস লেখা। সিনেমা নাটকে অভিনয় করা। নৃত্যগীত চর্চা। আর রাজনৈতিক ভাষণ। বাক বিতণ্ডা এবং গালাগালি! এর বাইরে বাংলা ভাষার কোন ভুমিকা নাই, বাঙালির ব্যক্তি জীবন ও সমাজ জীবনে। একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাদেশে সরকারী ভাবে বাংলা ভাষা কিছুটা হলেও ভেন্টিলেশনে রয়েছে।
না, বাৎসরিক একুশ পালনের পার্বণেও আমাদের সম্বিত ফেরেনি। আর রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক এই দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি পাওয়ায়, বাংলাভাষার যেটুকু জায়গা তৈরী হওয়ার আশা ছিল সেটুকুরও সলিল সমাধি ঘটে গিয়েছে। কারণ দিনটি আর কোনভাবেই শুধু বাংলা ভাষার নয়। বিশ্বের সকল ভাষারই দিন। একুশ তাই আজকে মাতৃভাষার উদযাপন। বাংলা ভাষার নয়। অন্তত স্বাধীন বাংলাদেশের বাইরে পড়ে থাকা পূর্বতন অবিভক্ত বাংলার বিস্তৃত খণ্ডে তো নয়ই। আবার একথাও স্মরণে রাখা দরকার, সারা বছরে একটি নির্দিষ্ট দিনে অতীতের একটি ঘটনার স্মরণেই বাংলা ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। যে জাতি নিজে থেকেই জীবনের প্রায় প্রতিটি দিকেই আপন মাতৃভাষা বাংলাকে বিসর্জন দিয়ে ব্রাত্য করে রেখেছে, সেই জাতির হাতেই তার মাতৃভাষার বিলুপ্তি লেখা রয়েছে।
আমরা আগেই দেখিয়েছি, পূর্বতন অবিভক্ত বাংলার একাধিক অঞ্চলে আজ কিভাবে শাসনকর্মে বাংলা ব্রাত্য হয়ে গিয়েছে। ঐতিহাসিক ভাবেই বাঙালির ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে হাজার হাজার বছর ধরে বাংলা ভাষা ব্রাত্য হয়ে পড়ে রয়েছে। একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের ঢক্কানিনাদে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলা ভাষা হিসাবে কতটা অপাঙতেয়। এবং একথাও তো সত্য, আমাদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার দিগন্তেও বাংলার কোন প্রবেশাধিকার নাই আজও। বাংলা ভাষার উপরে নির্ভর করে কেউ চিকিৎসক কিংবা স্থপতি হয়ে উঠতে পারেন না। প্রযুক্তির দিগন্তে এই ভাষা আচল। একজন আইনবিদ হয়ে উঠতে গেলেও বাংলা কোন ভাবে নির্ভরতা জোগাতে সক্ষম নয়। অর্থাৎ মানুষের প্রতিদিনের জীবন যাপনে যে যে পরিসেবাগুলি জোগান দেওয়া জরুরী। সেইগুলির জোগান নিশ্চিত করতেও বাংলা ভাষার কোন অধিকার ও সক্ষমতা তৈরী হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি বাঙালির প্রকৃতিগত পরনির্ভরতা ও নকলনবিশি ধর্মের কারণেই। বাঙালি চিরকালই অধিকতর সক্ষম ও উন্নত জাতির উপর নির্ভরশীল। বাঙালি কোনদিনই আত্মনির্ভর হয়ে ওঠায় বিশ্বাসী নয়। বাঙালির সকল কর্মকাণ্ডই মূলত অন্যের নকলনবিশি। আমরা নকল করায় পারদর্শী। আমরা অনুকরণে বিশ্বাসী। আমাদের রাজনৈতিক মতবাদ, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান সকলই মূলত অনুকরণজাত ঐতিহ্য। আমাদের নিজস্বতা মূলত কলহ ও দলাদলিতেই নিঃশেষ।
তাই বাৎসরিক একুশ উদযাপনের দিগন্তে আমরা একটি উৎসব মুখর দিবস পালনের সুযোগ পেয়েছি মাত্র। তার বেশি কিছু অর্জন করতে সক্ষম হই নি। ব্যাতিক্রম শুধু একটিই, সেটি স্বাধীন বাংলাদেশর আত্মপ্রকাশ। বাহান্নোর একুশ না হলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতো না। পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা যেমন ভারতের একটি প্রদেশ। তেমনই পূর্বপাকিস্তানের বাঙালিও পাকিস্তানের একটি প্রদেশের বাসিন্দা হয়ে পড়ে থাকতো আজও। তাই একুশের সাথে বাংলা ভাষার সংযোগ ততটা প্রাসঙ্গিক নয় আর। যতটা প্রাসঙ্গিক পূর্ব বাংলার স্বাধীন বাংলাদেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের। বাকিটা ঘন অন্ধকার। সেখানে বাংলা ভাষা অবলুপ্তির আশঙ্কায় সমাচ্ছন্ন। একুশের বাংলাভাষা তাই একটি ঐতিহাসিক দিবসের সীমানাতেই অবরুদ্ধ। অন্তত বাঙালির চেতনায় বাঙালিত্বের বোধ যতদিন না জাগ্রত হয়ে ওঠে। যদি না হয়ে ওঠে আদৌ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন